ছোট্ট সেই শাহান আলীর বয়স এখন ২৭ বছর। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে হাত-পা বাঁধা শাহানের। এ বয়সে এখন দশজন তরুণের সাথে ছুটে চলার কথা, পরিশ্রম করে সংসার চালানোর এবং লেখাপড়া করেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কথা। কিন্তু শাহান জন্মের ৬ বছর পর মানসিক ভারসাম্য হারার কারণে তাঁকে বেঁধে রাখতে হয়েছে।
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার চণ্ডীগড় ইউনিয়নের থাপনারগাতি গ্রামে শাহান আলীর বাড়ি। ওই গ্রামের আবদুল মজিদ মিয়ার ছেলে শাহান আলী। জন্মের বছর ৬ বছর পরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন শাহান পরিবারের সদস্যরা। শাহানের বাবা একজন কৃষণ। কৃষক আবদুল মজিদ টাকার অভাবে তার সন্তানের কোন রকম চিকিৎসা করতে পারছেন না। সে জন্য তার সন্তানের ২ হাত একসঙ্গে, আবার কোন সময় দুই পা বেঁধে রাখতে হচ্ছে তাকে। এভাবেই দিন পার করছেন তিনি।
শাহনের পরিবারের বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৯৯৬ সালের ১৩ নভেম্বর শাহানের জন্ম হয়। জন্মের পর পরেই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ঠিক ৬ বছর পূর্ণ হওয়ার পর থেকেই শাহানের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। সে সময় তাঁকে একা ছেড়ে দিলে ছোটাছুটি করতে। আর সামনে যাকে পেতেন, তাকেই ধরে মারতেন। সেই অঞ্চলের গরু, হাঁস, মুরগি, ছাগলকে মারাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে পেলেও আঘাত করার চেষ্টা করতেন।
শাহানের চিকিৎসার জন্য দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার সেখানকার চিকিৎসকেরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসার কথা বলার পরে সেই দরিদ্র পরিবারটি শাহানের চিকিৎসার জন্য নিতে পারেনি। পরে কিছুদিন চিকিৎসা ময়মনসিংহে রেখে দেওয়ার পর তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া যায়। ধীরে ধীরে শাহান বড় হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর অস্বাভাবিক আচরণ ঠিক ততই বেড়ে যাচ্ছিল। সে কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে তার পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সব সময় এভাবেই বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়।
শাহান আলীর মা রহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার এই ছেলেডারে লইয়া অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। রাইতেও ভালোভাবে ঘুমাইতেও পারি না। রাইত-দিন সব সময় হাত বাইন্দা রাখতে হয়। আমি তার মা হইয়া এই দৃশ্য দেখতে অনেক কষ্ট হয়। টেহার লাইগ্গা হ্যার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেহাইতে পারি না। সরকার যদি আমার এই ছেলেডার জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে হ্যায় সুস্থ হয়ে যেত। সব সময় দড়ি ও শিকল দিয়া বেঁধে রাখায় তার হাত-পা ক্ষত হয়ে গেছে।
প্রতিবেশী রহমত আলী বলেন, শাহানকে দিনে বেলায় খোলা আকাশের নিচে গাছের সঙ্গে ও রাত হলে খুঁটির সঙ্গে হাত-পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সেখানেই চলে তাঁর খাওয়াদাওয়াসহ সবকিছু। এভাবেই দির্ঘ ২১ বছর ধরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শাহানের বন্দিজীবন কাটছে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করতে পারছে না তার পরিবারটি।
তার বাবা আবদুল মজিদ মিয়া বলেন, ‘আমি একজন গরিব মানুষ। সংসারও ভালো চলে না। এই ছেলেডার জন্য চিকিৎসা করতে করতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। ট্যাহার অভাবে এখন আর চিকিৎসা করতে পারি না। সরকারি সহায়তা বা অন্য কেউ যদি টাকা দিয়ে একটু সহযোগিতা করত, তাহলে তার চিকিৎসা করানো যেতো। শাহানের চিকিৎসা করলে হয়তো সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসত। আমি তার বাবা হয়ে সন্তানের এই দশা দেখা যে কী কষ্ট, তা আমি বোঝাতে পারব না।
এ ব্যাপারে দুর্গাপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহানের এ রকম সমস্যার কথা আমি এক দিন আগে শুনেছি। তার বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে, সরকারিভাবে শাহানের চিকিৎসার বাবাদ ৫০ হাজার টাকা সহযোগিতা করার জন্য। এ ছাড়াও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বলা হয়েছে, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কিছু আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
সূত্র:- Right News BD