বাংলাদেশকে যে সতর্কবার্তা দিচ্ছে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের কারণে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে একটি চড়া ভবন ধসে পড়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ৮ তলা ভবনের ঊর্ধ্বের ৩ তলা বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে ভবনের স্বত্বাধীকারী কিছু অর্থদন্ড দিয়েই ভবনটিকে বৈধ্য করেছিলেন।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পপ্রবণ দেশে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসছেন যে ভবন নির্মাণের সময় সঠিক নিরাপত্তা বিধি না মানা হলে জরিমানাসহ ‘ক্ষমা’ হওয়ার সম্ভব্য বস্তু বড় ধরনের দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে।
২০১৯ সালের বিল্ডিং ধসের পরে, চেম্বার অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের চেয়ারম্যান সেমাল গোকসে বলেছিলেন, “এর গুরুত্ব হল আমাদের শহরগুলি, বিশেষ করে ইস্তাম্বুলকে কবরস্থানে বায়োপ্রাপ্ত করা এবং কফিনগুলিকে বাড়ি থেকে বের করে নেয়ার জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করা।” (তুর্কি শহরগুলি বিল্ডিং অ্যামনেস্টি, ইঞ্জিনিয়ার হি, রয়টার্স, ২০১৯ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি)
৪ বছর পরে, তুর্কি প্রকৌশলীদের উদ্বেগ সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। এ রকম পরিস্থিতে একটি বিশাল এলাকা আক্ষরিক অর্থেই কবরস্থানে পরিণত হয়েছে, সিরিয়া ও তুরস্কে ৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পে হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ার পর। তুরস্কের প্রায় ২০ হাজার ৫ শত অধিবাসী সহ এ পর্যন্ত ভূমিকম্পে ২৪ হাজার জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।
তুর্কি সরকার এই বিপুল সংখ্যক মানুষ মৃত্যুর কারণে ভূমিকম্পের প্রচণ্ডভাবে দায়গ্রস্ত করলেও তুরস্কের প্রচলিত মানুষ এবং বিশেষজ্ঞরা ভবন নির্মাণে অনিয়মকে বাধ্য করছেন। গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিক আল-জাজিরাকে বলেছেন, ইস্তাম্বুলের বোগাজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্দিলি অবজারভেটরি আর ভূমিকম্প। “ভূমিকম্পে মানুষের মৃতের সংখ্যা এতখানি পাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে ভবনগুলি উন্নতমানের প্রস্তুত করা হয়নি। “
সাম্প্রতিক সময়কে উপক্ষো করে তুরস্ক ও সিরিয়ায় এ রকম হওয়া থেকে অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উপযুক্তভাবে তৎক্ষনাত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে শক্তিহীন অবকাঠামোগত ভবনগুলোর লক্ষনীয় করা এবং সেগুলো ভবন পুনর্বাসন কর্মসূচির উদ্দেগ্য তৈরি করা। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বিল্ডিং এর কোড মেনে চলা নিশ্চিত করা আর পিছনের দিকে ভবন নির্মাণের জন্য একটি অধিষ্ঠিত পরিকল্পনা তৈরি করা। ভূমিকম্প উদ্ধার অভিযান এবং চিকিৎসা ও স্বাভাবিক ড্রিলিং, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি এবং জরুরী স্থাপনাগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সহ বিভিন্ন সেবা।
এর পূর্বে ১৯৯৯ সালে, দেশের উত্তর-পশ্চিমে ইজমিট অঞ্চলগুলোতে ক্ষমতাশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ অকালে জীবন হারিয়েছিলেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ তুরস্ক কঠোর বিল্ডিং নির্মাণ আইনের কাছাকাছি রয়েছে, যার বিগত সংস্করণ ২০১৮ সালে গঠিত হয়েছিল। তবে এই আইনগুলির উপযুক্ত প্রয়োগের অভাবের সময়ে জরিমানার বিনিময়ে গতানুগতিক ক্ষমার বিধানের কারণে, যথাযথভাবে তুরস্কের পুরানো ভবনগুলো ভূমিকম্পের জন্য পরীক্ষা করা হয়নি, অনেক নব-নির্মিত ভবনগুলোও ভূমিকম্প-প্রমাণ করা হয়নি।
বিবিসির সঠিক তথ্য অনুসারে দেখা গেছে, শুধুমাত্র পূর্বের তৈরকিৃত ভবনই নয়, ভূমিকম্পের জন্য বহু বর্তমানে নির্মিত ভবনগুলোও ধসে পড়েছে, যা এসব ভবন নির্মাণে অনিয়মের জন্য সংকেত দেয় হয়। দক্ষিণ তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থলের জন্য প্রায় ৭৫ হাজার ভবন ব্যপক ক্ষমার আওতায় পড়ে। বিবিসি, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ (তুরস্কের ভূমিকম্প: কেন এতগুলো বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে)?
২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে রীতি অনুযায়ী তুরস্কের ক্ষমতাসীন এরদোগান সরকার জরিমানার বিনিময়ে বিল্ডিং কোড না করার কারণে নির্মিত বিল্ডিংগুলিকে আইনসম্মত করার একটি কর্মসূচি স্বীকার করেছিল। তখন জরিমানার পরিবর্তে ক্ষমা চেয়ে ১ কোটির আবেদনপত্র রাজস্বখাতে জমা পড়ে, যার ভিতরে মঞ্জুর করা হয় ১ লাখ ৫০ হাজার চালান। ২০১৯ সালের সময়, তুরস্কের সরকার ভবন নির্মাণে অনিয়ম গতি ক্ষমাশীলতা করে ৩১০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে। (বিল্ডিং অ্যামনেস্টির মাধ্যমে তুর্কি শহরগুলি ‘কবরস্থান’ হতে পারে, ইঞ্জিনিয়াররা বলে, রয়টার্স, ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি)
ভূমিকম্পে প্রসন্ত প্রাণহানি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ধারণ করে। তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বাংলাদেশও একটি ভূমিকম্পপ্রবণ স্থান, সিলেট সীমান্তে ক্রিয়াশীল ডাউকি চ্যুতির স্থান এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতির অবস্থান এবং সীমান্ত বরাবর ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তর-পূর্ব, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের বিপদগ্রস্থ রয়েছে।
১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে যথাযথভাবে কয়েকটি বৃহৎ ভূমিকম্প হয়েছিল। পরে কিছু ছোট ভূমিকম্প হলেও বড় ভূমিকম্প আর হয়নি।
যাইহোক, কেননা গত ১০০ বছরে কোন প্রকার বড় ধরণের ভূমিকম্প হয়নি, তাই ভূতাত্ত্বিকরা মনে করছেন যে ছোট কম্পনগুলি ক্ষমতা সংগ্রহ করছে এবং ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের আতঙ্ক তৈরি করছে। বাংলাদেশে তুরস্কের মতো ক্ষমতাশালী ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকাসহ ঘন বাসস্থান শহরগুলোর কত শতাংশ ভবন টিকে থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। (বিবিসি বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ভবনগুলো কতটা ভূমিকম্প-প্রতিরোধী?)
ভবন নির্মাণের জন্য সেগুলো যথাযথভাবে সঠিক আইন মানা হয় না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশে ভবন নির্মাণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী । অন্যথায় আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নগর কর্তৃপক্ষের অবহেলাও সর্বজনস্বীকৃত, সমসময় অভিযান পরিচালনায় ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়মিত তদারকি ব্যতিরেকে পরিস্থিতির কোনো বিনিময় হচ্ছে না।
গৃহায়ণ আর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদিত কর্তব্য দিয়ে বণিক সংবাদে বলা হয়েছে, দেশের শহরাঞ্চলে নির্মিত ও নির্মাণাধীন ভবনের ৬০ শতাংশই নিয়ম না মেনে নির্মানের সকল কাজ ঝুঁকিপূর্ণভাবে করা হচ্ছে।
এর ভিতরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন ৬৫.০৩ শতাংশ ভবন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ২৮.৫৭ শতাংশ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে ৫৩.৬৯ শতাংশ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৬৭.৯৬ শতাংশ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ২৩ শতাংশ ভবন। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ভবনগুলোর শতকরা ৯০ শতাংশ আলাদা নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মিত।
ভবন নির্মাণে অনিয়মের ভিতরে রয়েছে অনুমোদিত উচ্চতার থেকে বেশি ভবন নির্মাণ, নকশার বাইরে ভবন সম্প্রসারণ, আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, ভবনের চারপাশে প্রয়োজনীয় ফাঁকা জায়গা না রাখা, সঠিকভাবে অগ্নি সংক্রমনের ব্যবস্থা না রাখা ইত্যাদি (60%) শহরাঞ্চলে ভবন নির্মাণে অনিয়ম।
এভাবে নিয়ম না মেনে নির্মিত ভবনগুলো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সূত্র:- Right News BD