দৈনন্দিন জীবনে যতই দিন যাচ্ছে ততই আমাদের বাচ্চাদের মোবাইল ফোন-এর উপর আসক্তিতে শিকার হচ্ছে।
আমরা যদি শীঘ্রই এ পদক্ষেপ হাতে না নেই তাহলে, অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার তাদের জীবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারে।
আপনি কি বাচ্চাদের উপর মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী থাকলে বিস্তারিত পড়ুন।
কিভাবে বাচ্চারা প্রথমে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়?
বর্তমান সময়ে যে কোন কাজের ক্ষেত্রে চলতে গেলে মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত চলার কথা ভাবতে পারি না।
শত ব্যস্ততা থাকার কারণে বেশিরভাগ শিশুই মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
এছাড়াও অনেক অভিভাবকরা আছেন শিশুদের বিরক্ত সহ্য না করতে পেরে তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে গেমস, গান, কার্টুন কিংবা মজার মজার ভিডিও প্লে করে দেন।
এর ফলে শিশুরা দিনে দিনে মোবাইল সহ অন্যান্য অ্যাপস কিংবা বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্তি আরও বেড়ে যেতে থাকে।
কেন বাচ্চারা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়?
অনেক পরিবারে লক্ষ করা যায় মা-বাবা দুজনই চাকরি বা বিভিন্ন কাজে অনেক সময় বাইরে থাকার কারণে তাদের বাচ্চারা টিভি বা মোবাইল ফোনের আসক্ত হয়ে পড়ে।
সে জন্য বিকাল বেলায় বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বাইরে খেলা-ধুলা বা ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করুন। যেমন- নাচ, গান, আবৃত্তি সহ তারা যেগুলো করতে ভালোবাসে সেগুলো শেখান।
মোবাইল ফোন বাচ্চাদের কি কি ক্ষতি করে?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে মোবাইলের রেডিয়েশনের কারণে শিশুর চোখে এবং দেহের উপর পড়ে। এতে নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এমনকী এটির ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
তাই সে কারণেই বাচ্চাদের আচরণে বিরক্ত না হয়ে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে না দেওয়াই ভালো।
বর্তমান বিশ্বে কত শতাংশ শিশু ফোনে আসক্ত?
বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৯ শতাংশ শিশুরা স্মার্টফোনের উপর মারাত্মকভাবে আসক্তি হয়ে পড়েছে।
তবে প্রতি ১০ জন মায়েদের ৪ জন শিশুই স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে জানেন না।
সম্প্রতি সময়ে তিন থেকে পাঁচ বছরে ৪০০টি প্রি ক্যাডেট স্কুলের শিশুর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় এমন একটি তথ্য পাওয়া গেছে।
শিক্ষার্থীদের জীবনে মোবাইল ফোনের আসক্ত কিরকম প্রভাব ফেলছে?
মোবাইল ফোনের সকল বিষয়বস্তু সবসময়ের জন্য শিশুদের জন্য নাও হতে পারে। অধিকন্তু, কিছু কিছু পিতা-মাতা আছেন তাদের সন্তানরা যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে তখন তারা পর্যবেক্ষণ করেন না।
সেহেতু বাচ্চাদের হাতে ফোন দিয়ে ব্যস্ত রাখে এতে করে বৃদ্ধরাও এটিকে সুবিধাজনক মনে করেন, কারণ তারাও তাদের কাজ শেষ করার জন্য সময় পান।
যাইহোক, তারা বুঝতে পারে না যে, দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ, মস্তিস্কের প্রভাব ফেলে মন এবং তাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে।
স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে কিভাবে শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে?
বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোনগুলি রেডিওফ্রিকোয়েন্সি বিকিরণ নির্গত করে, যা তাদের কভারেজ প্রদানকারী সেল টাওয়ারের সাথে সংযুক্ত করে।
স্মার্টফোন যে সংকেত নির্গত করে তাকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বা EMF বলে। এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন অন্যান্য বিকিরণকে কভার করে।
যেমন তাপ এবং মাইক্রোওয়েভ, যা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার সময় উপজাত হিসাবে নির্গত হয়।
যখন আমরা আমাদের কানের কাছে আমাদের মোবাইল ফোন রাখি, তখন রেডিও ওয়েভগুলি সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কে চলে যায়। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেলে। ডব্লিউএইচওর মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধির মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে।
বাচ্চারা মোবাইল ফোনের খারাপ প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তাদের শরীর এখনও বিকশিত হচ্ছে। অধিকন্তু, তাদের হাতে, পকেটে বা ব্যাগে মোবাইল ফোন বহন করার ফলে ইএমএফের অতিরিক্ত এক্সপোজার হয়।
এই এক্সপোজারটি চলতে থাকে কারণ বাচ্চারা যখন ঘুমায় তখন তাদের মাথার কাছে ফোন রাখে।
শিক্ষার্থীদের উপর মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে আরও পড়ুন…
এখানে বাচ্চাদের মোবাইল ফোনের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি ক্ষতিকারক প্রভাবের তালিকা দেওয়া হলো:
- দুর্বল দৃষ্টি
- মনোযোগের অভাব
- উদ্বেগ সৃষ্টি
- পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট
- খারাপ একাডেমিক কর্মক্ষমতা
- দুর্ঘটনার কারণ
- ঘুম কমে যাওয়া
- খারাপ ভঙ্গি
- অনৈতিক কার্যকলাপ
- সাইবার বুলিং
১. দুর্বল দৃষ্টি:
মোবাইল ফোনের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকার কারণের চোখের দৃষ্টিশক্তি এবং চোখের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
চোখ শুকিয়ে যায় এবং চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এতেকরে দৃষ্টিশক্তি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাচ্চাদের পড়তে অসুবিধা হয়।
দিনরাত ফোন ব্যবহার করার কারণে চোখের স্বাস্থ্য নষ্ট করে এবং এর প্রভাব সারাজীবন ধরে থাকে। এটি সাধারণত মোবাইল ফোনের ব্যবহারের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ নেতিবাচক প্রভাবগুলির মধ্যে একটি।
২. মনোযোগের অভাব:
বাচ্চারা যখন মোবাইল ফোনে যেসব ভার্চুয়াল জগত দেখে তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর হয়। কিন্তু এসব জিনিসকে শিক্ষার্থীরা এটিকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে এবং এতে ঘন্টার পর ঘন্টা দীর্ঘ সময় ব্যয় করে।
এটা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয় বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে যেমন, এটি তাদের পড়াশোনা এবং খেলাধুলা থেকেও বিভ্রান্ত করে। বাচ্চারা তাদের বইয়ের চেয়ে তাদের ফোনে বেশি সময় কাটানোর আগ্রহ থাকে।
তখন তারা ধিরে ধিরে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এতে দিনে দিনে তাদের পড়াশোনার মনোভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. উদ্বেগ সৃষ্টি:
বিভিন্ন ভিডিও গেম সহ অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার তাদের বিরক্ত করে তোলে না বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেশি উদ্বেগও সৃষ্টি করে তোলে।
তাদের এই ক্রমাগত ফোন ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থীরা কম বয়সেই মাথাব্যথা এবং মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগে, যা আরও উদ্বেগ এর দিকে নিয়ে যায়।
৪. পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট:
অতিরিক্ত মোবাইল ফোনের ব্যবহারের কারণে অনেক শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারে না।
ফলে দেখা যায় তারা তাদের জীবনের বড় ধরণের বিপদ সম্মুখীন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে।
কারণ তাদের মোবাইল ফোনে নিজেদের হারিয়ে ফেলে। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটি প্রভাব।
৫. খারাপ একাডেমিক কর্মক্ষমতা:
তাদের মূল্যবান সময়টি দীর্ঘ সময় ধরে ফোনের পিছনে ব্যয় করার কারণে একসময় দেখা যায় খারাপ একাডেমিক পারফরম্যান্সের দিকে পরিচালিত করে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সময় মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়।
এতে তাদের স্মৃতিশক্তি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিন দিন তাদের মন নিস্তেজ ও অলসতায় ভুগতে থাকে।
৬. দুর্ঘটনার কারণ:
বাচ্চাদের মোবাইল ফোনের আসক্তি এতটাই প্রবল করে যে, তারা হাত থেকে ফোন ছেড়ে দিতে চায় না।
এমনকি রাস্তায় হাঁটতে গেলে সেই সময় মোবাইলের দিকে সমানে নজর দিয়ে থাকে। এতে করে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
৭. ঘুম কমে যাওয়া:
অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে তাদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নির্গত রেডিয়েশন স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
এছাড়াও ফোন থেকে নির্গত নীল আলো এমনকি রাতেও মস্তিষ্ককে জাগ্রত করে।
৮. খারাপ ভঙ্গি:
সারাদিন দীর্ঘ সময় ধরে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে, মাথা বাঁকানো এবং কাঁধ ঝুলিয়ে রাখাটাও এক ধরণের খারাপ ভঙ্গি।
যা কিনা ঘাড় ব্যথা, মাথাব্যথা এবং পিঠে ব্যথা হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হতে পারে।
৯. অনৈতিক কার্যকলাপ:
বাঁকী সবগুলোর থেকে আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেটে বিভিন্ন অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু। এগুলো তাদের এমন কিছু গল্পকাহিনীর মধ্যে পার্থর্কের বিষয়ে মুগ্ধ করে তোলে।
এটির প্রতি তারা বিভ্রান্ত হয়ে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতের টান এতই প্রবল যে, তারা এটা সামাজিক অশান্তির প্রভাব তৈরি করে।
১০. সাইবার বুলিং:
সাইবার বুলিং মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষার্থীদের মনের উপস্থিতির অভাব রয়েছে। তারা ভার্চুয়াল জগতে উপস্থিত নেতিবাচক উপাদানগুলির শিকার হচ্ছে।
যার কারণে তারা উদ্বেগ, বিষণ্ণতায় ভুগছে, পাশাপাশি সাইবার বুলিদের হাতে মানসিক নির্যাতনের কারণে সমাজে সম্মান অনেকটাই কমে যাচ্ছে।
কিভাবে শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোন ব্যবহার কমাতে পারে?
শিক্ষার্থীদের উপর মোবাইল ফোনের সকল প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর অন্যতম কার্যকর উপায় হল তাদের দীর্ঘ সময় ধরে স্মার্টফোনের ব্যবহার কমানো।
এটির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ফোনের ব্যবহার বন্ধ করতে বাধ্য করা অনেক বেশি কার্যকর হবে।
এটি ছাড়াও, মা-বাবারা নিম্নলিখিত বিষয়ে চেষ্টা করতে পারেন
ফোন কলের মাধ্যমে যোগাযোগের পরিবর্তে, ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা বা লাউডস্পীকারে ফোন ব্যবহার করলে মাথার মধ্যে যোগাযোগ অনেকটাই কমে যায়।
এটি বিকিরণ এক্সপোজার থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করবে।
বাবা-মায়েরা রাতে তাদের ফোন বন্ধ করে কাজে ব্যস্ত থাকে বা ফোনের প্রয়োজন হয় না তখন একটি উদাহরণ স্থাপন করতে পারে।
পরে এটি ঘনত্ব, মনোযোগ এবং ঘুম উন্নত করতে সাহায্য করবে।
পিতা-মাতারা সঠিক মাসিক পরিকল্পনা বেছে নিতে পারেন যা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফোন কল এবং পাঠ্য পাঠাতে অনুমতি দেয়।
এতে বাচ্চাদের ফোন ব্যবহার অনেকটা কমে যাবে এবং মোবাইল ফোনের খারাপ প্রভাব থেকে সরে আসবে।
উপসংহার:
মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত গ্যাজেটগুলি আমাদের জন্য বিভিন্ন উপায়ে উপযোগী। এছাড়াও যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে।
যাইহোক, বাচ্চাদের এটি থেকে সীমিত ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে, আমাদের একটি প্রয়োজনীয় কারণ আমাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরণের ক্ষতিকর দিক হতে পারে।
সূত্র:- Right News BD
One thought on “বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ১০টি ক্ষতিকর দিক”
Comments are closed.