শরীরের যেকোন অংশে এলার্জি দেখা দিলে অতিরিক্ত চুলকানি শুরু হয়। এই সমস্যাটি যেকোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে খুব কমন একটি সমস্যা। তাছাড়া বাচ্চাদের শরীরে চুলকানি হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।
তাছাড়া বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গায়ের চুলকানি হওয়ার সম্ভবনা অনেকটাই কমে যায়।
শরীরে এলার্জি চুলকানি হওয়ার কারণ
অনেকের হয়তো বাল্যকাল থেকে চুলকানি হওয়ার সমস্যা নাও থাকতে পারে। তবে পরে শরীরে চুলকানি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা থেকে রেহােই পেতে সঠিক কিছু নিয়ম মানলে শরীরের অতিরিক্ত চুলকানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
আগে আমরা জেনে নিব শরীরে অতিরিক্ত চুলকানি হওয়ার কারণসমূহ। তারপর জেনে নিব চুলকানি দূর করার উপায় সম্পর্কে-
আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে শরীরের যেকোন সমস্যা থেকে আমাদেরকে সুরক্ষা করে। মূলত সারা শরীরে চুলকানি হয় বিভিন্ন সংস্পর্শের মাধ্যমে। সেই সংস্পর্শগুলোর মাধ্যমে শরীরে চুলকানি যাতে না হয় সেগুলোর সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
পুরো শরীরে চুলকানি দেখা দেয় যেগুলোর সংস্পর্শে-
- নির্দিষ্ট কিছু খাবারের কারণে
- ধুলাবালি
- অতিরিক্ত গরম অথবা ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে চুলকানি হওয়ার কারণে
- ঘাম
- গৃহপালিত পশু-পাখির কারণে
- পরাগ রেণু ও ফুলের রেণু
- সূর্যরশ্মি
- মোল্ড বা ছত্রাক
- বিভিন্ন ঔষধ
- কীটনাশক
- বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন, ডিটার্জেন্ট
- রাবারের তৈরি এমন গ্লাভস কিংবা কনডম থেকেও চুলকানি হতে পারে
- স্ট্রেস বা অতিরিক্ত মানসিক চাপ
এলার্জি জাতীয় খাবারের তালিকা
যেসব খাবার খেলে শরীরে চুলকানি দেখা দিতে পারে-
- চিংড়ি
- বেগুন
- ইলিশ মাছ
- গরুর মাংস
- বাদাম
- বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য ডিম ও দুধ থেকে এলার্জিক সমস্যার কারণে তাদের শরীরে চুলকানি দেখা দিতে পারে।
একেকজন মানুষের একেক ধরনের খাবারে এলার্জি থাকতে পারে। তাই কোন ধরনের জিনিসের সংস্পর্শে বা খাবার খেলে এলার্জির চুলকানি লক্ষণ দেখা দিচ্ছে সেই বিষয়ে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এটি খুঁজে বের করতে পারলে এলার্জির মত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
শরীরে চুলকানি ও ফুসকুড়ি হওয়ার লক্ষণ সমূহ
- শরীরের হাত-পা কিংবা যে কোন অংশে চাকা হয়ে ফুলে যাওয়া, চামড়া ফোস্কা পড়া।
- ঠোঁট, জিহ্বা, চোখ ও মুখ ফুলে যাওয়া।
- চোখে চুলকানি, চোখ দিয়ে পানি পড়া, লাল হয়ে ফুলে যাওয়া।
- শুকনো কাশি, হাঁচি, নাকে ও গলায় চুলকানি হওয়ার পাশাপাশি নাক বন্ধ হওয়া।
- শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ চাপ লাগা ও শ্বাস নেওয়ার সময়ে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া/্
- বমি বমি ভাব, বমি, পেট ব্যথা, পেট কামড়ানো ও ডায়রিয়া।
যখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
- নিচের তিনটি ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
- ঔষধ খাওয়ার পরেও চুলকানি হওয়ার লক্ষণ দূর না হলে।
- ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ খাওয়ার পর নতুন লক্ষণ দেখা দিলে কিংবা সমস্যা আরও বেড়ে গেলে
- মারাত্মক চুলকানি প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে
শরীরে চুলকানি দেখা দিলে অ্যানাফিল্যাক্সিস নামক একটি জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে। এ অবস্থায় দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এমন রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। সময়মতো একটি ইনজেকশন দিলেই রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব।
যেভাবে বুঝবেন আপনার অ্যানাফিল্যাক্সিস হচ্ছে কি না
- নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া
- বুক সহ গলা চেপে আসছে বলে মনে হওয়া
- মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা অথবা গলা ফুলে যাওয়া
- ঠোঁট ও ত্বক নীল হয়ে যাওয়া
- জ্ঞান হারানোর মতো অনুভূতি হওয়া অথবা পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- অহেতুক দুশ্চিন্তা হওয়া
- মাথা ঘোরার পাশাপাশি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
- বুক ধড়ফড় করা কিংবা শরীর ঘামে ভিজে যাওয়া
- ত্বকে চুলকানি সহ লাল ভাব ফুসকুড়ি হওয়া, বিভিন্ন জায়গায় ফুলে ওঠা
- শরীরের কিছু জায়গা থেকে চামড়া উঠে আসা কিংবা ফোস্কা পড়া
- এলার্জি আছে এমন খাবার ও ঔষধ, ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত কন্ট্রাস্ট বা ডাই অথবা পোকামাকড়ের কামড় থেকে অ্যানাফিল্যাক্সিস হতে পারে।
- এলার্জির চিকিৎসা
- গায়ে অতিরিক্ত চুলকানি যাতে না হয় সে জন্য নিয়মিত খাদ্য তালিকায় বিধিনিষেধ মেনে চললে শরীরে এলার্জি জনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
চুলকানি দূর করার ঘরোয়া উপায়
মনে রাখবেন, যেসব খাবার ও ঔষধে এলার্জি চুলকানি হয় সেগুলো এড়িয়ে চলবেন। তা না হলে হাঁপানি অথবা শ্বাসনালীর অন্য কোনো রোগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ মোকাবেলায় শারীরিক ব্যায়াম, যোগব্যায়াম ও শ্বাসের ব্যায়াম করা যেতে পারে।
ঔষধ
এলার্জির চিকিৎসায় প্রধানত অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এগুলো এলার্জির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে—এমনকি লক্ষণ দেখা দেওয়ার পূর্বেও সেবন করা যায়। যেমন, কারও যদি ধুলাবালিতে এলার্জি থাকে এবং বিশেষ প্রয়োজনে তার ধুলাবালি পরিষ্কার করতে হয়, সেক্ষেত্রে আগেই অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবন করা যায়।
চুলকানি ভালো হওয়ার বিভিন্ন ঔষধ কিনতে পাওয়া যায়। যেমন: ট্যাবলেট, সিরাপ ও ড্রপ। বিশেষ করে এলার্জির কিছু ঔষধ খাওয়ার পরে ঘুম ঘুম ভাব হওয়া বা মাথা ঝিম ঝিম হওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এরকম অনুভব হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে আপনার জন্য ভালো ঔষধটি বেছে নিতে হবে।
নাক বন্ধের সমস্যায় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নাক বন্ধের ড্রপ ও স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এই ড্রপ ও স্প্রেগুলো এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করবেন না। দীর্ঘ সময় ব্যবহারে এলার্জির লক্ষণ আবার ফিরে আসতে পারে।
ত্বকে এলার্জির কারণে চুলকানি হওয়ার কারণে বিভিন্ন ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম ও মলম ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকে চুলকানি সমস্যায় ক্যালামাইন লোশন (Calamine lotion) ভালো কাজ করে। এ ছাড়াও তোয়ালে বরফ পেঁচিয়ে চুলকানি হাওয়া স্থানে লাগালে অনেক আরাম পাওয়া যায়।
গুরুতর এলার্জিতে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ভালো কাজ করে। স্টেরয়েড খুবই শক্তিশালী ঔষধ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বেশি। তাই গুগলে সার্চ করে কিংবা পাশে থাকা ফার্মেসি থেকে নিজে নিজে এসব ঔষধ কিনে খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। কেবল ডাক্তারের পরামর্শক্রমেই নিয়ম মেনে এই ধরনের ঔষধ সেবন করা উচিত।
ইমিউনোথেরাপি
শরীরে অতিরিক্ত চুলকানি হওয়ার জন্য ইমিউনোথেরাপি একটি কার্যকরী চিকিৎসা হতে পারে। এই চিকিৎসায় রোগীকে দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়। এর ফলে পরবর্তীতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সেই অ্যালার্জেনের প্রতি পূর্বের মতো তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় না। ফলে লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেকটাই সহজ হয়ে আসে।
ওপরে উল্লেখিত যেকোন ব্যক্তির মারাত্মক এলার্জির সমস্যা বা অ্যানাফিল্যাক্সিস দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। তাছাড়া অ্যানাফিল্যাক্সিসের লক্ষণ দেখা দিলে
সেই রোগীর ঊরুর বাইরের দিকে জরুরী ভিত্তিক একটি ইনজেকশন দিতে হয়। এই ইনজেকশনে অ্যাড্রেনালিন নামক একটি হরমোন দেওয়া থাকে। ইনজেকশনটি দেওয়াতে অনেকটাই মৃত্যুঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
চুলকানি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়
চুলকানি থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে যেসব জিনিসের মধ্যে এলার্জি রয়েছে সেগুলো এড়িয়ে চলা। এলার্জি প্রতিরোধ করতে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলতে পারেন-
বাড়ির পশু-পাখি থাকার জায়গা বাইরে তৈরি করুন। পাশাপাশি নিয়মিত আপনার গৃহপালিত পশু-পাখিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
বাড়ির যেসব জায়গাগুলোতে হয় সেগুলো ধুলামুক্ত ও পরিষ্কার রাখুন। বিছানার চাদর, কাঁথা, বালিশ ও লেপের কভার, জানালার পর্দা—এগুলো সপ্তাহে অন্তত একবার গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। যেসব জিনিস নিয়মিত ধোয়া যায় না সেগুলো বাসায় যত কম ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। যেমন: কার্পেট।
এ ছাড়া বিছানা গোছানো ও ঝাড়া-মোছা করার সময়ে ভালো একটা মাস্ক পড়ুন। যেসব জিনিস ভেজা কাপড় দিয়ে মোছা যায় সেগুলো ভেজা কাপড় দিয়ে মুছুন। এতে ধুলা ছড়াবে না।
ত্বকের এলার্জি চুলকানি টেস্ট করার পর রোগ নির্ণয়
প্রথমে এলার্জির কারণ খুঁজে বের করার জন্য একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডাক্তার বিভিন্ন প্রশ্ন করার পর শারীরিক পরীক্ষা করেন। তা ছাড়া অন্য কোনো রোগের কারণে এলার্জির মতো লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখেন। এলার্জির মত শনাক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো হলো-
নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
যেসব খাবার খেলে শরীরে এলার্জি থেকে চুলকানি অনুভুত হয় সেগুলো খাবার বাদ দিতে হবে। চুলকানি সেরে যাওয়ার পরে আবার সেই খাবারগুলো খেতে শুরু করলে এলার্জি ফিরে আসে কি না তাও দেখার চেষ্টা করা হয়। সাধারণত এলার্জির লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর চুলকানি হয়েছে এমন রোগী কোন ধরনের খাবার খাওয়ার কারণে হচ্ছে সেটি ডায়েরিতে লিখে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে করে কোন কোন খাবার খেলে শরীরে চুলকানি হয় তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় সহজে।
চর্মরোগ সংক্রান্ত পরীক্ষা
যেসব পদার্থে এলার্জি হয় সেসবকে অ্যালার্জেন বলে। অ্যালার্জেন যুক্ত অল্প একটু তরল বাহুর ওপরে ত্বকের পরীক্ষাতে দেওয়া হয়। এরপর সেই জায়গায় সামান্য সুঁই দিয়ে একটু ছিদ্র করা হয়।
শরীরে এলার্জির মত সমস্যা থাকলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে সেই জায়গায় চুলকানি শুরু করলে লাল হয়ে যায়।
মনে রাখবেন, শরীরে অতিরিক্ত চুলকানি হওয়ার স্থান পরীক্ষা করার আগে অবশ্যই অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না।
রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট
রক্ত পরীক্ষার নমুনা নিয়ে নির্দিষ্ট অ্যালার্জেন এর বিপক্ষে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা করে দেখা হয়।
এলার্জি কি
দেহে প্রবেশের পর প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে তৈরির প্রতিক্রিয়াকেই এলার্জিক বলা হয়। যেমন-
পরিবেশ দূষণের কারণে নাকে ধুলাবালি প্রবেশ করলে হাঁচি-কাশি হওয়া।
সেন্সিটিভিটি
কোনো উপাদান শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেললে তাকে সেই উপাদানের প্রতি সেন্সিটিভিটি বলা হয়ে থাকে। যেমন: এক কাপ কফিতে থাকা ক্যাফেইন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করলে বুক ধড়ফড় করতে পারে এবং শরীরে কাঁপুনি দেখা দিতে পারে।
অসহনীয়তা: কোনো কারণে শরীরে অস্বস্তির লক্ষণ দেখা দেওয়াকে অসহনীয়তা বলা হয়। যেমন: দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার পর ডায়রিয়ার লক্ষণ। বিশেষ করে এই ধরনের সমস্যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সম্পর্ক থাকে না।
পরিশেষে:
আশা করি আজকের আলোচনায় এলার্জি চুলকানি দূর করার উপায় ও লক্ষণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। আপনার শরীরে যদি অতিরিক্ত চুলকানি দেখা দেয় তাহলে, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর উপার ভিত্তি করে চুলকানি দূর করার উপায় গ্রহণ করতে পারেন। তাছাড়া আপনার শরীরে যদি অতিরিক্ত চুলকানি অনুভব করেন তাহলে একজন চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে পারেন।
সূত্র:- Right News BD