পৃথবীতে এমন অনেক ক্যানসারের উপসর্গ রয়েছে। সেগুলো ক্যানসারের মধ্যে এমন যে ৩ ক্যানসার রয়েছে যেগুলো অনেক নারী দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও লজ্জায় ভুগে থাকেন, যা তারা গোপন রাখার চেষ্টা করেন।
এছাড়াও আত্মিয় স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করেন এবং চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। এর ফলে রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়, যা নারীদের ক্যানসার চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে অনেক নারী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে চিকিৎসা নিতে দেরি করেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ক্যানসার সময়মতো শনাক্ত করা হলে সফলভাবে আরোগ্য করা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা জরুরি।
নারীদের ক্ষেত্রে যে ৩ ক্যানসার বেশি দেখা দেয়
জরায়ুমুখ ক্যানসার
বিশ্বজুড়ে এই ক্যানসার চতুর্থ স্থানে থাকলেও বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের পরেই এর অবস্থান। অথচ এটি এমন একটি ক্যানসার, যা সহজেই প্রতিরোধযোগ্য এবং প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ সম্ভব।
উন্নত দেশগুলোতে এই ক্যানসারের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেক কম হলেও, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে শতকরা ৯০ ভাগ রোগীই মৃত্যুবরণ করেন। সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীরা এই ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হন। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) নামক ভাইরাসের কারণে জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়।
ঝুঁকি বাড়ানোর কারণসমূহ
বাল্যবিবাহ বা কম বয়সে সহবাস, অধিক সন্তান ধারণ, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, বহুগামিতা, দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, ধূমপান, প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ, এবং এইচআইভি আক্রান্ত নারীদের মধ্যে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।
ক্যানসারের লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায় লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে সহবাসের পর রক্তক্ষরণ, মাসিক বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত, অতিরিক্ত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, তলপেটে ও কোমরে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা, যোনিপথ দিয়ে প্রস্রাব বা পায়খানা নির্গত হওয়া, এবং প্রস্রাবে রক্ত দেখা যেতে পারে।
ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়:
১. ভ্যাকসিন বা টিকা প্রদান: ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে এই টিকা দেওয়া যাবে, তবে যৌনমিলন শুরুর পূর্বে দিলে কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। সরকার ইতিমধ্যেই কিশোরীদের বিনামূল্যে এই টিকা প্রদান শুরু করেছে। তাই দেরি না করে আপনার কন্যাশিশুকে অবশ্যই টিকার আওতায় আনবেন।
২. স্ক্রিনিং টেস্ট: অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় জরায়ুমুখ ক্যানসার একটি বড় সুবিধা হলো এটি স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে ক্যানসার-পূর্ব অবস্থায়ই শনাক্ত করা যায়। এই পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে ক্যানসার হওয়া থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব, এবং নারী তার স্বাভাবিক নারীত্ব বজায় রাখতে পারেন। স্ক্রিনিং টেস্টগুলোর মধ্যে রয়েছে এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট, প্যাপ টেস্ট, এবং ভায়া টেস্ট। এই টেস্টগুলো তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর করা উচিত। অনেকেই প্রশ্ন করেন যে টিকা নেওয়ার পরেও কি স্ক্রিনিং টেস্টের প্রয়োজন আছে কি না। তাদের জানা দরকার যে, টিকা নিলেও স্ক্রিনিং টেস্ট করা জরুরি।
৩. কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে না দেওয়া, অধিক সন্তান ধারণ থেকে বিরত থাকা, নিরাপদ যৌনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, ধূমপান না করা, এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন মেনে চলা জরুরি।
শনাক্ত করার উপায়: কোনো উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে জরায়ুমুখের বায়োপসি করে ক্যানসার শনাক্ত করা হয়।
চিকিৎসা
ক্যানসারের স্টেজ অনুযায়ী সার্জারি, রেডিওথেরাপি, এবং কেমোথেরাপি ব্যবহার করে এই ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়।
ডিম্বাশয়ের ক্যানসার
ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারকে “নীরব ঘাতক” বলা হয় কারণ প্রাথমিক অবস্থায় এর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এটি শরীরে অনেকটা ছড়িয়ে পড়ার পরই উপসর্গ প্রকাশ পায়।
দিন দিন ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী প্রজননতন্ত্রের ক্যানসারগুলোর মধ্যে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার সবচেয়ে মারাত্মক। ক্যানসার-পূর্ব অবস্থা ছাড়া হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
যেকোনো বয়সের নারী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন, তবে ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে জার্ম সেল ক্যানসার এবং ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে এপিথেলিয়াল ওভারিয়ান ক্যানসার বেশি দেখা যায়।
উপসর্গ
ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের নির্দিষ্ট উপসর্গ না থাকলেও সাধারণত ক্ষুধামান্দ্য বা অরুচি, পেট ফুলে যাওয়া। এছাড়াও অল্প খাবারে পেট ভরা অনুভূতি, পেটে পানি আসা, বমি বা বমি বমি ভাব, ওজন কমে যাওয়া, পেটে চাকা অনুভব করা, পেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, সহবাসে ব্যথা, অনিয়মিত প্রস্রাব-পায়খানা এবং কখনো কখনো মাসিকের অনিয়ম দেখা দিতে পারে।
করণীয়
উপসর্গ দেখা দিলে অথবা যদি ডিম্বাশয়, স্তন, বা জরায়ু ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তাহলে অবহেলা না করে দ্রুত গাইনিকোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করে শারীরিক চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি শনাক্ত করা উচিত।
চিকিৎসা
ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের মূল চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারি। পাশাপাশি কেমোথেরাপি এবং কিছু ক্ষেত্রে টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া হয়।
রোগীর বয়স, সন্তান নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, ক্যানসারের ধরন ও স্টেজের ওপর ভিত্তি করে কনজারভেটিভ বা রেডিক্যাল সার্জারি করা হয়ে থাকে।
জরায়ু বা ইউটেরাইন ক্যানসার
উন্নত দেশে নারীদের মধ্যে এই ক্যানসারের প্রবণতা বেশি, তবে দিন দিন নিম্ন আয়ের দেশগুলিতেও এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে এটি মেনোপজের পর দেখা যায়, তবে ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরা ৪০ বছর বয়সের আগেই আক্রান্ত হতে পারেন।
ঝুঁকি বাড়ানোর কারণসমূহ: বয়স্ক ও স্থূলকায় নারী, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, পিসিওএস বা বন্ধ্যাত্বের সমস্যা, কম সন্তানের সংখ্যা, মেনোপজাল হরমোনথেরাপি গ্রহণ, কম বয়সে মাসিক শুরু হয়ে বেশি বয়সে বন্ধ হওয়া, এবং জরায়ু, কোলোন ও ওভারিয়ান ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
উপসর্গ
মেনোপজের আগে বা পরে ক্যানসারের উপসর্গের প্রকারভেদ হতে পারে। মেনোপজের আগে, অনিয়মিত মাসিক এবং মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হলে সতর্ক হওয়া উচিত।
মেনোপজের পর, রক্তপাত বা রক্তযুক্ত স্রাব, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, পায়খানা ও প্রস্রাবে অনিয়ম এবং পেটে চাপ অনুভব এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়
উপসর্গ দেখা দিলে একটি ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রাফি ও প্যাপ টেস্ট করার পর চূড়ান্ত নির্ণয়ের জন্য ডি অ্যান্ড সি অথবা হিস্টরোস্কোপির মাধ্যমে বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়। ক্যানসারের স্টেজ নির্ধারণের জন্য এমআরআই করতে হতে পারে।
চিকিৎসা
ক্যানসারের স্টেজ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হলেও মূল চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারি, যা প্রায়শই ডিম্বাশয়সহ জরায়ু অপসারণের মাধ্যমে করা হয়। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে এমন অঞ্চলগুলো অপসারণ করতে হতে পারে। এছাড়া, প্রয়োজন অনুযায়ী রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোনথেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করা হতে পারে।
চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়। রোগ বা উপসর্গ নিয়ে লজ্জা বা আতঙ্ক না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সুফল বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া নারীদের যে ৩ ক্যানসার একমাত্র চিকিৎসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিয়মিত ফলোআপ।
চিকিৎসা সম্পন্ন হওয়ার পরও নির্দিষ্ট সময় অন্তর শারীরিক পরীক্ষা ও কিছু টেস্টের মাধ্যমে রোগটি ফিরে আসছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। নারীদের ক্যানসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার বিষয়ে পরিবারের সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
সূত্র: Right News BD