হলুদ দাঁত আমাদের হাসিকে কম আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। যদিও অনেকেই হলুদ দাঁত সাদা করার বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করেন। এসব পণ্য ব্যবহারের ভালো ফলাফল তবে ঘরোয়া উপায়ও কার্যকরী হতে পারে।
দাঁত হচ্ছে মানুষ সহ সকল প্রাণীদের মুখে অবস্থিত একটি অঙ্গ। এটি খাদ্য চর্বণ ও কর্তনের (কাটা) কাজে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ প্রাণীর দেহে দাঁতই হচ্ছে এক ধরণের শক্ত অঙ্গ।
আসুন এই পোস্টে আমরা জেনে নেই হলুদ দাঁত ঝকঝকে সাদা করার সহজ ও প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে-
হলুদ দাঁত সাদা করুন সহজ উপায়ে
১. বেকিং সোডা ও লেবুর রস
বেকিং সোডা: সোডিয়াম বাইকার্বনেট (IUPAC নাম: সোডিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগ, যার রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে NaHCO₃। এটি সাধারণত সাদা কঠিন স্ফটিক আকারে পাওয়া যায়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি মিহি পাউডারের আকারে ব্যবহৃত হয়।
সোডিয়াম বাইকার্বনেটের স্বাদ কিছুটা লবণাক্ত এবং সোডিয়াম কার্বনেটের মতো হালকা ক্ষারীয়।
সোডিয়াম বাইকার্বনেটের প্রাকৃতিক খনিজ রূপ হলো নাকোলাইট, যা খনিজ ন্যাট্রনের একটি উপাদান। এটি প্রাকৃতিক ঝর্ণার পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায়ও পাওয়া যায়।
দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের কারণে এই যৌগটি বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে, যেমন: বেকিং সোডা, ব্রেড সোডা, কুকিং সোডা, এবং বাইকার্বনেট অব সোডা।
সোডিয়াম বাইকার্বনেটকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক খাদ্য উপাদান হিসেবে অনুমোদিত করা হয়েছে। এটি বেকিং, কুকিং এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের খাবার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। এর প্রধান কাজ হলো খাদ্যের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করা, যা বেকিং-এর সময় আটা বা মিশ্রণকে ফুলতে সাহায্য করে।
লেবুর রস: লেবুতে প্রায় ৫% থেকে ৬% সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে, যার কারণে এটি একটি টক স্বাদযুক্ত প্রাকৃতিক উপাদান। এর পিএইচ মান প্রায় ২.২, যা লেবুকে একটি উচ্চমাত্রার অ্যাসিডিক ফল হিসেবে চিহ্নিত করে।
লেবুর রসের এই টক স্বাদ বিভিন্ন পানীয় ও খাবারের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। জনপ্রিয় পানীয় যেমন লেবুর শরবত এর প্রধান উপাদান হিসেবে লেবুর রস ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া, লেবু মেরিংয়ে পাই এর মতো মিষ্টি খাবারেও লেবুর রস ব্যবহার করা হয়, যা খাবারের স্বাদে টক-মিষ্টি ভারসাম্য আনে।
প্রয়োগ পদ্ধতি
বেকিং সোডা ও লেবুর রসের এই মিশ্রণটি দাঁতে আলতোভাবে ব্রাশ দিয়ে প্রয়োগ করুন।
১-২ মিনিট ধরে দাঁতে ঘষুন, তবে খুব জোরে ঘষবেন না, কারণ এতে দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেজন্য কুলি করে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
সতর্কতা
প্রতিদিন এই মিশ্রণ ব্যবহার করবেন না, কারণ লেবুর রসের অ্যাসিড দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সপ্তাহে ১-২ বার ব্যবহার করা যেতে পারে।
ব্যবহার করার পর মুখে ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন এবং দাঁত ব্রাশ করতে পারেন, যাতে দাঁতের ওপর লেবুর অ্যাসিডের কোনো প্রভাব না থাকে। এই মিশ্রণটি সপ্তাহে একবার ব্যবহার করুন।
২. লবণ পানি
লবণ একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক। লবণাক্ত পানি (সাধারণত নোনা পানি হিসাবে পরিচিত) এই পানিতে দ্রবীভূত লবণের উচ্চ ঘনত্ব (প্রধানত সোডিয়াম ক্লোরাইড) থাকে। ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) লবণাক্ততার স্কেলে, লবণাক্ত পানিরলবণাক্ততা পানির চেয়ে বেশি, তবে ব্রাইনের চেয়ে কম।
এটি ব্যবহারের জন্য, এক চামচ লবনের সাথে পানি মিশিয়ে ব্যবহার করলে দাঁতের হলদে ভাব কমাতে সাহায্য করে।
৩. স্ট্রবেরি
স্ট্রবেরি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ফল। স্ট্রবেরিতে আছে ম্যালিক অ্যাসিড, ভিটামিন এ, সি, ই, ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পলিফেনল, এলাজিক এসিড, ফেরালিক এসিড, কুমারিক এসিড, কুয়েরসিটিন, জ্যান্থোমাইসিন ও ফাইটোস্টেরল। স্টবেরী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় , হার্টের ঝুঁকি সহ ডায়াবেটিস ও কোস্টকাঠিন্য, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, ওজন কমাতে সহায়ক, দেহের হাড় ও ত্বক সুরক্ষা করে, চুল পড়া রোধ করে , স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি এবং রূপচর্চায় উপযোগী সহ দাঁত সাদা করতে সাহায্য করে।
এটি ব্যবহারের জন্য, কিছু স্ট্রবেরি ম্যাশ করে দাঁতে লাগান এবং ৫-১০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
৪. কোষ্ঠী
কোষ্ঠী মুখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং দাঁতের হলুদ ভাব কমায়। দৈনিক কোষ্ঠী ব্যবহার করুন।
৫. তেল
নারকেল তেল হল একটি সাদা কঠিন চর্বি যা প্রায় 25 °C (77 ° ফারেনহাইট) এর নিচে এবং উচ্চ তাপমাত্রায় একটি পরিষ্কার পাতলা তরল তেল। অপরিশোধিত জাতগুলির একটি স্বতন্ত্র নারকেল সুবাস রয়েছে।
নারকেল তেল একটি খাদ্য তেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
এই তেল ব্যবহারের ফলে দাঁত এবং মাড়ির জন্য খুবই উপকারী। নারকেল তেল দিয়ে ১৫-২০ মিনিট গাল করতে পারেন।
৬. আপেল
আপেলে অনেক পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে, যা স্বাস্থ্যকর ডায়েটের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে আপেলের প্রধান উপাদানগুলোর তালিকা দেওয়া হলো:
আপেলের প্রায় ৮৬% পানি, যা শরীরে হাইড্রেশন বজায় রাখতে সাহায্য করে।
আপেলে প্রায় ১৩-১৫% কার্বোহাইড্রেট থাকে, যার মধ্যে বেশিরভাগই প্রাকৃতিক শর্করা, যেমন ফ্রুকটোজ, গ্লুকোজ ও সুক্রোজ।
আপেলে প্রচুর ফাইবার থাকে, বিশেষ করে পেকটিন নামক একটি দ্রবণীয় ফাইবার। এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে ও রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
- ভিটামিন সি (Vitamin C): আপেলের একটি প্রধান ভিটামিন, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
- ভিটামিন এ (Vitamin A): স্বাস্থ্যকর ত্বক এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য উপকারী।
- ভিটামিন কে (Vitamin K):** রক্ত জমাট বাঁধা এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক।
পটাসিয়াম (Potassium): শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রাখতে সহায়ক।
ক্যালসিয়াম (Calcium): হাড় এবং দাঁতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium): স্নায়ুতন্ত্র এবং পেশী সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয়।
আপেলে ফ্ল্যাভোনয়েডস (Flavonoids) এবং ফেনোলিক যৌগ রয়েছে, যা শরীরে প্রদাহ কমাতে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
আপেলের প্রাকৃতিক শর্করা ফ্রুকটোজ এবং সুক্রোজ শরীরে তাত্ক্ষণিক শক্তি যোগাতে সহায়ক।
একটি মাঝারি আকারের আপেলে প্রায় ৯৫ ক্যালোরি থাকে, যা কম ক্যালোরির স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিবেচিত।
আপেলে আরও কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ থাকে, যা শরীরের জন্য উপকারী।
আপেলের ফাইবার দাঁত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। আপেল খাওয়ার পর মুখে স্বচ্ছ পানি ব্যবহার করুন।
৭. চালের পানি
ভাতের পানি হল স্টার্চের একটি সাসপেনশন যা সিদ্ধ চাল নিষ্কাশন করে বা চাল সিদ্ধ করে যতক্ষণ না এটি সম্পূর্ণরূপে পানিতে দ্রবীভূত হয়।
এটি কখনও কখনও পাচনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে চিকিৎসার জন্য লোকেদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
চালের পানি মুখে ব্যবহার করলে দাঁতের হলুদ ভাব কমাতে সাহায্য করে। রান্নার পর চালের পানি সংগ্রহ করে এতে কুলি করুন।
৮. দারুচিনি ও মধু
দারুচিনি, (ইংরেজি নাম: Cinnamon) (বৈজ্ঞানিক নাম: Cinnamomus Zeylanicum) দারুচিনির বাকলে থাকে “সিনামাল ডিহাইড”, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ আছে। স্বাভাবিক পরিবেশে এই বৃক্ষের উচ্চতা দশ থেকে পনের মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
- মধু হলো এক প্রকারের মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করে এবং মৌচাকে সংরক্ষণ করে। মধুতে ৪৫টিরও বেশি খাদ্যগুণ। তার মধ্যে কয়েকটি হলো:
- ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ,
- ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ,
- ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ
- ৫ থেকে ১২ শতাংশ মন্টোজ
- ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড
- ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ
- ১১ শতাংশ এনকাইম
- ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ৩০৩ ক্যালরি।
- তাছাড়া এটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ।
প্রাকৃতিকভাবে দারুচিনি এবং মধু দাঁত সাদা ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এই মিশ্রণ দাঁতে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৯. গোলাপ জল ও লবঙ্গ
গোলাপ ফুলের পাপড়ি থেকে প্রস্তুতকৃত সুরভীত যে জল তৈরী করা হয় তাকেই গোলাপ জল বলা হয়।
লবঙ্গ গাছের ফুলের কুঁড়িকে শুকিয়ে লবঙ্গ মসলাটি তৈরি করা হয়। লবঙ্গে আছে অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ক্র্যাটেগলিক অ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, র্যাম্নেটিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন।
গোলাপ জল ও লবঙ্গের মিশ্রণ মুখের জন্য খুবই উপকারী। এটি দাঁতের হলদে ভাব কমায় এবং মুখের গন্ধও দূর করে।
১০. প্রতিদিনের যত্ন
দাঁতের সঠিক যত্ন ও নিয়মিত ব্রাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করলে দাঁতের হলুদ ভাব কমানো সম্ভব।
পরিশেষে
সহজে আপনার হলুদ দাঁত সাদা করার ক্ষেত্রে এই ঘরোয়া উপায়গুলো প্রাকৃতিকভাবে বেশ কার্যকর।
নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে আপনার দাঁত সাদা করতে পারেন। তবে যেকোনো সমস্যা হলে দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সুত্র: Right News BD