শীতকাল আসলেই চুলের বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়, তাই শীতে চুলের যত্নে কিছু বাড়তি ঘরোয়া উপায় জেনে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তীব্র ঠাণ্ডা আবহাওয়া, কম আর্দ্রতা এবং শুষ্ক বাতাস চুলকে রুক্ষ ও শুষ্ক করে তোলে। ফলে চুল ভেঙে যাওয়া, খুশকি এবং চুল পড়ার সমস্যাও বেড়ে যায়।
শীতের সময় চুলের এসব সমস্যার সমাধানে আপনি সহজে কিছু ঘরোয়া উপায় ব্যবহার করে আপনার চুলকে সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখতে পারবেন।
আসুন চুলের যত্নে ৯টি কার্যকরী ঘরোয়া উপায় জেনে নিই।
৯টি ঘরোয়া উপায়ে শুষ্ক আবহাওয়ায় শীতে চুলের যত্নে হারানো জেল্লা ফিরে আনুন
১. নারকেল তেলের ম্যাসাজ (শীতে চুলের যত্নে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে সহায়ক)
নারকেল তেল চুলের জন্য খুবই উপকারী। শীতকালে চুল শুষ্ক হয়ে যায়, এবং নারকেল তেল চুলের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে।
চুলের যত্নে নারকেল তেলের পুষ্টিগুণ:
পুষ্টি উপাদান | অ্যাকশন (চুলের যত্নে) | উপকারিতা |
---|---|---|
লরিক অ্যাসিড (Lauric Acid) | চুলের গোড়ায় প্রবেশ করে | চুলের প্রোটিন হানি রোধ করে, চুল মজবুত করে |
ভিটামিন ই (Vitamin E) | চুলের কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে | চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে, খুশকি দূর করে |
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) | অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় | চুলের কোষ সুরক্ষা করে, অকালে চুল পড়া রোধ করে |
ফ্যাটি অ্যাসিড (Fatty Acids) | চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে | শুষ্কতা রোধ করে, চুলকে নরম ও মসৃণ করে |
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রপার্টি (Antibacterial & Antifungal Properties) | স্ক্যাল্পের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে | খুশকি ও স্ক্যাল্প ইনফেকশন দূর করে |
মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (Monounsaturated Fat) | চুলের প্রোটেক্টিভ লেয়ার মজবুত করে | চুলের ক্ষতি কমায়, প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বাড়ায় |
এই সমস্ত নারকেল তেলের পুষ্টিগুণ চুলের প্রোটিন, চুল মজবুত, চুলের বৃদ্ধি, চুলের খুশকি দূর করতে, চুলের কোষ সুরক্ষা, অকালে চুল পড়া রোধ, চুলের শুষ্কতা রোধ সহ প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ফেরাতে সাহায্য করে।
শীতে চুলের পরিচর্যা করতে নারকেল তেল সপ্তাহে ২-৩ দিন হালকা গরম মাথায় ম্যাসাজ করুন। এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে এবং চুলের গোড়া শক্ত হবে।
২. মধু ও দইয়ের প্যাক (চুল নরম ও মসৃণ করতে সাহায্য করে)
ঠান্ডায় চুলের যত্নে মধু প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে এবং দই চুলকে পুষ্টি জোগায়।
চুলের যত্নে মধু ও দইয়ের পুষ্টি উপাদান:
উপাদান | পুষ্টি উপাদান | অ্যাকশন (চুলের যত্নে) | উপকারিতা |
---|---|---|---|
মধু (Honey) | অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) | চুলের ক্ষতি রোধ করে | অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, চুল পড়া কমায় |
হিউমেক্ট্যান্ট (Humectant) | চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে | শুষ্কতা রোধ করে, চুল নরম ও মসৃণ রাখে | |
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল (Antibacterial) | স্ক্যাল্পের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে | খুশকি ও স্ক্যাল্প ইনফেকশন কমায় | |
প্রাকৃতিক চিনি (Natural Sugars) | চুলে পুষ্টি সরবরাহ করে | চুলের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বাড়ায় | |
দই (Yogurt) | প্রোটিন (Protein) | চুলের ক্ষতি মেরামত করে | চুলের গোড়া মজবুত করে, চুল পড়া রোধ করে |
ল্যাকটিক অ্যাসিড (Lactic Acid) | মৃত কোষ দূর করে | স্ক্যাল্প পরিষ্কার রাখে, নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে | |
প্রোবায়োটিক (Probiotics) | স্ক্যাল্পের স্বাস্থ্য উন্নত করে | সংক্রমণ রোধ করে, খুশকি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক | |
ফ্যাটি অ্যাসিড (Fatty Acids) | চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে | চুলের শুষ্কতা ও রুক্ষতা কমায় | |
ভিটামিন বি৫ (Vitamin B5) | চুলের বডি ও ঘনত্ব বাড়াতে সহায়ক | চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে, চুল শক্তিশালী করে |
মধু ও দইয়ের কার্যকরী পুষ্টি উপাদানগুলো শীতকালে চুলের সব সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে।
রেশমের মতো নরম আর মসৃণ চুলের যত্নে ২ টেবিল চামচ মধু ও ৩ টেবিল চামচ দই মিশিয়ে চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত লাগান। তারপর ৩০ মিনিট রেখে শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন।
৩. অ্যালোভেরা জেল (চুলের শুষ্কতা এবং বৃদ্ধিতে সহায়ক)
চুলের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে অ্যালোভেরা জেল এর উপকারিতা অপরিসীম। শীতকালে চুলে শুষ্কতার সমস্যা কমাতে চুলে অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করুন।
চুলের যত্নে অ্যালোভেরার পুষ্টিগুণ
পুষ্টি উপাদান | অ্যাকশন (চুলের যত্নে) | উপকারিতা |
---|---|---|
ভিটামিন এ (Vitamin A) | স্ক্যাল্পের তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে | শুষ্কতা ও স্ক্যাল্পের খুশকি প্রতিরোধ করে |
ভিটামিন সি (Vitamin C) | চুলের ফ্রি র্যাডিক্যাল ক্ষতি রোধ করে | চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক, চুলকে উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর রাখে |
ভিটামিন ই (Vitamin E) | চুলের কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে | চুলের ক্ষতি কমায়, চুলকে মজবুত ও উজ্জ্বল করে |
প্রোটোলিটিক এনজাইম (Proteolytic Enzymes) | মৃত চুলের কোষ দূর করে | স্ক্যাল্প পরিষ্কার রাখে, নতুন চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে |
ফ্যাটি অ্যাসিড (Fatty Acids) | প্রদাহ কমায় | স্ক্যাল্পের প্রদাহজনিত সমস্যা ও ইনফেকশন কমায় |
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল (Antibacterial & Antifungal) | স্ক্যাল্পের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে | খুশকি ও অন্যান্য স্ক্যাল্প ইনফেকশন রোধ করে |
অ্যামিনো অ্যাসিড (Amino Acids) | চুলের গঠন মজবুত করে | চুল পড়া রোধ করে, চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক |
পানি (Water) | চুলে আর্দ্রতা ধরে রাখে | চুলের শুষ্কতা ও রুক্ষতা দূর করে, চুল নরম রাখে |
শীতকালে চুলের শুষ্কতা দূর করতে অ্যালোভেরার কার্যকরী পুষ্টি উপাদান চুলের বৃদ্ধি করার পাশাপাশি উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
৪. বাদাম তেলের ব্যবহার (শীতে চুলের রুক্ষতা ও চকচকে করতে সাহায্য করে)
শীতের সময় চুলের যত্নে বাদাম তেলের উপাদান অত্যন্ত উপকারি।
চুলের যত্নে বাদাম তেলের পুষ্টিগুণ
উপাদান | পুষ্টি উপাদান | অ্যাকশন (চুলের যত্নে) | উপকারিতা |
---|---|---|---|
ভিটামিন ই (Vitamin E) | শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট | চুলের কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে | চুলের ক্ষতি রোধ করে, চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে |
ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega Fatty Acids) | আর্দ্রতা ধরে রাখে | চুলকে নরম, মসৃণ এবং স্বাস্থ্যকর রাখে | |
প্রোটিন (Protein) | চুলের গঠন মজবুত করে | চুলের ক্ষতি কমায়, চুল পড়া রোধ করে | |
বায়োটিন (Biotin) | চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে | চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে, চুল পড়া রোধ করে | |
ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium) | স্ক্যাল্পের স্বাস্থ্য উন্নত করে | চুলের গোড়া মজবুত করে, খুশকি ও স্ক্যাল্পের শুষ্কতা দূর করে | |
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) | চুলের প্রোটিন হানি রোধ করে | অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে চুল পড়া রোধ করে | |
ফ্যাটি অ্যাসিড (Fatty Acids) | চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে | চুলের শুষ্কতা ও রুক্ষতা দূর করে, নরম রাখে | |
জিঙ্ক (Zinc) | চুলের কোষগুলো পুনর্গঠন করে | চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক, খুশকি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে |
শীতের সময় রাতে ঘুমানোর আগে সপ্তাহে ১-২ বার বাদাম তেল মাথায় ম্যাসাজ করুন।
এই সমস্ত বাদাম তেলের কার্যকরী পুষ্টি উপাদানগুলো চুলের রুক্ষতা দূর করার পাশাপাশি চুলকে শক্তিশালী ও চকচকে করতে সাহায্য করবে।
৫. ডিমের হেয়ার মাস্ক (চুলের ভঙ্গুরতা ও শুস্কতা দূর করতে সহায়ক)
ডিমের পুষ্টি উপাদান শীতের সময় চুল শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
শীতে চুলের যত্নে ডিমের পুষ্টি উপাদান
পুষ্টি উপাদান | অ্যাকশন (শীতে চুলের যত্নে) | উপকারিতা |
---|---|---|
প্রোটিন (Protein) | চুলের গঠন মজবুত করে | শীতে চুলের শুষ্কতা ও ভঙ্গুরতা রোধ করে, চুলকে শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যকর রাখে |
বায়োটিন (Biotin) | চুলের কোষ পুনর্গঠন করে | শীতে চুল পড়া কমায়, চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক |
ভিটামিন এ (Vitamin A) | স্ক্যাল্পের তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে | শুষ্ক স্ক্যাল্প ও খুশকি প্রতিরোধ করে, চুল মসৃণ ও নরম রাখে |
ভিটামিন ডি (Vitamin D) | চুলের ফোলিকল মজবুত করে | শীতে চুলের ঘনত্ব বজায় রাখতে সহায়ক |
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 Fatty Acids) | চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে | শীতকালে শুষ্কতা দূর করে, চুল নরম ও মসৃণ রাখে |
ভিটামিন ই (Vitamin E) | চুলের কোষগুলিকে সুরক্ষা দেয় | শীতকালে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে চুলের ক্ষতি রোধ করে |
লেসিথিন (Lecithin) | চুলে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সহায়ক | চুলকে শীতে শুষ্ক ও রুক্ষ হওয়া থেকে রক্ষা করে, চুল নরম রাখে |
ফলেট (Folate) | নতুন কোষ উৎপাদন বৃদ্ধি করে | চুলের দ্রুত বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য বজায় রাখে, শীতে চুল পাতলা হওয়া রোধ করে |
চরম শীতে চুলের যত্নে ডিমের পুষ্টি উপাদানগুলো পেতে ১টি ডিম, ২ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল এবং ১ টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে একটি হেয়ার মাস্ক তৈরি করুন। তারপর এটি চুলে ২০-৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
চুলের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে ডিমের এই হেয়ার মাস্ক ব্যবহারের ফলে আপনার চুলের ভঙ্গুরতা দূর করবে এবং উজ্জ্বলতা এনে দেবে।
৬. মেথি বীজের পেস্ট (চুলের শুষ্কতা ও খুশকির সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে)
চুলের খুশকি থেকে পরিত্রাণ পেতে মেথি বীজের পেস্ট খুবই কার্যকর।
এই পেস্ট তৈরির জন্য ২ টেবিল চামচ মেথি বীজ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে করুন।
সকালে চুলের গোড়ায় লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
এটি চুলের শুষ্কতা ও খুশকির সমস্যা দূর করবে।
৭. ঘৃতকুমারী এবং নারকেল দুধের হেয়ার প্যাক (চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক)
চুলের যত্নে ঘৃতকুমারী প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে। ঘৃতকুমারীর রস এবং নারকেল দুধ একসাথে মিশিয়ে একটি হেয়ার প্যাক তৈরি করুন। এটি চুলে ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
এটি ব্যবহারের পর চুল হবে উজ্জ্বল এবং সিল্কি।
৮. অল্প গরম পানি দিয়ে চুল ধোয়া (রুক্ষ ও শুষ্ক চুলকে রক্ষা করে)
শীতে অনেকে গরম পানি দিয়ে চুল ধুতে পছন্দ করেন, কিন্তু খুব বেশি গরম পানি চুলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এটি চুলের প্রাকৃতিক তেল ধ্বংস করে ফেলে। তাই অল্প গরম পানি দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন, এতে চুল রুক্ষ হবে না।
৯. চুলে সুতির কাপড়ের ব্যবহার (অতিরিক্ত চুল পড়া রক্ষা করতে সহায়ক)
শীত বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে চুল ভেঙে যাওয়ার সমস্যাও বেড়ে যায়।
তাই চুল বাঁধার সময় সিনথেটিক কাপড়ের বদলে সুতির কাপড় ব্যবহার করুন। এতে চুলের ঘর্ষণ কমবে এবং অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যা কমবে।
সবশেষে: শীতে চুলের যত্নে এই ৯টি ঘরোয়া উপায় নিয়মিতভাবে পালনে চুল শুষ্কতা, রুক্ষতা, খুশকি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।
আজকের পোষ্টে চুলের যত্নে প্রাকৃতিক উপায়গুলোর ব্যবহার চুলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে খুবই উপকারী।
সূত্র: Right News BD