বর্তমান সময়ে ত্বকের এলার্জি নিয়ে অনেকে চিন্তিত। বিশ্বের প্রায় ৩% শিশু এই রোগে আক্রান্ত। এই রোগটি ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা মারা যাওয়ার কোন রকম সম্ভাবনা নেই। তবে এই রোগটি মাঝে মধ্যে বিরক্তিকর হয়ে থাকে। ত্বকের এলার্জি বিশেষ করে ত্বকে কালচেভাব দেখা দেয় এবং তাতে প্রদাহ বা ইরিটেশন হয়। সোরিয়াসিস শরীরের যেকোন জায়গায় হতে পারে। যেমন,
হাত, পা, হাতের কনুই, পায়ের হাঁটু, পিঠের নিচের দিকে। এছাড়াও আক্রান্ত স্থানে ছোট ছোট আঁশের মতো উঠতে দেখা যায়। কিছুটা হলেও এ রোগটি বংশগত থেকেও বিস্তার লাভ করে।
কেন ত্বকে এলার্জি হয়
সোরিয়াসিস রোগের পেছনে রয়েছে ‘এপিডার্মাল টার্নওভার’। সাধারণ অবস্থায় এই এপিডার্মাল টার্নওভারের জন্য ২৮ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, প্রতি ২৮ দিন অন্তর আমাদের বহিঃত্বক বদলায়। যদি কোনওভাবে এই সময়টা কমে যায়, অর্থাৎ ৩-৪ দিনে নতুন এপিডার্মিস তৈরি হতে শুরু করে, তখনই বিপদ হয়। আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সোরিয়াসিস রোগটি হওয়ার পেছনে শরীরের সুরক্ষাসংক্রান্ত বিশৃঙ্খলার জন্য এই সমস্যাই দায়ী।
এই সময় শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থা শরীরের স্বাস্থ্যকর কোষগুলিকে ভয়ানক বলে মনে করতে থাকে। এখন এই রোগটি থেকে নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা পাওয়া যায় না বলেই চলে।
সোরিয়াসিস (ত্বকের এলার্জি) লক্ষণ
সোরিয়াসিস (ত্বকের এলার্জি) প্রধানত শীতকালীন সময়ে বেশি দেখা দেয়। অর্থাৎ শীতকালীন সময়ে এই রোগ প্রবল আকার ধারণ করে। আবার গরমের সময় কিছুটা হলেও কমে যায়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ত্বকের এলার্জি হওয়ার প্রধান লক্ষণ হল বুক ও পিঠে ব্রণের মতো ছোট ছোট লাল লাল ফুসকুড়ি। তাছাড়া সেখান থেকে আঁশ উঠতে থাকে। মূলত এটিকে গাটেট সোরিয়াসিস (Guttate Psoriasis) বলে।
এই রোগের কারণে অনেক সময় হাতের নখও আক্রান্ত হয়। এছাড়াও নখে ছোট ছোট গর্ত দেখা দেয়। নখ মোটা হয়ে ফুলে যায়। আবার অনেক সময় নখ ভেঙেও যায়। এমনকি তলার চামড়া থেকে নখ খুলে আসে। সোরিয়াসিস যখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে ইরিথ্রোডার্মিক (Erythrodermic) সোরিয়াসিস বলে। আক্রান্ত অংশ চুলকায় না। তবে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে ঘামের জন্য অনেক সময় চুলকানি হয়। আক্রান্ত ত্বকের এলার্জি অংশে বেশি চুলকালে রক্ত বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে।
সোরিয়াসিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাথা থেকে চুল উঠতে শুরু করে। খুশকির মতো স্কেল ওঠে। সাধারণত এ কারণেই খুশকির সাথে সোরিয়াসিসকে গুলিয়ে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে অনেকেই সেই ভুলটাই করেন।
দীর্ঘদিন যাবৎ সোরিয়াসিসে ভুগতে থাকলে অনেক সময় ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত ৫৬ থেকে ৫৭ দিন অন্তর নতুন ত্বকের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সোরিয়াসিস হলে নতুন ত্বক সৃষ্টির গতি অনেকটাই বেড়ে যায়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে অন্য সিস্টেমেটিক ডিজিজ অর্থাৎ সোরিয়াটিক আর্থারাইটিস (হাত বা পায়ের আঙুলের মতো দেহের ছোট ছোট গাঁটগুলোতে প্রবল আকারে ব্যথা) হয় না। তবে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড-এ এই সিস্টেমেটির ডিজিজগুলো হয় না।
সোরিয়াসিস এর কারণে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নখে সংক্রমণ কম হলেও অন্যান্য অংশের সংক্রমণ দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়।
ত্বকের এলার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভাল থাকার উপায়
ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার আগে ত্বকের এলার্জি দেখা দেওয়ার সম্ভবনা থাকে। প্রাকৃতিকভাবে শীতকালে এমনিতেই ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। তাই এই সময়ে বিশেষ কিছু সতর্কতা না মানলে সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। এই রোগ থেকে বাঁচতে নিচের পরামর্শ মেনে চলুন তাহলে অনেকটাই উপকার পাওয়া যাবে।
সাবান: ত্বকের এলার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিদের গোসলের সময় সাবান না ব্যবহার করাই ভাল। তবে মাখলেও শীতকালে প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক দিনের বেশি কোনভাবেই মাখা যাবে না। তাছাড়া সাবান কম ক্ষারযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তেল: গোসলের আগে অবশ্যই শরীরে তেল মাখা উচিত। তেল হিসেবে নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল মাখা যায়। তবে সরিষার তেল কোনভাবেই মাখা যাবে না। এতে করে ত্বকের জন্য ক্ষতি হতে পারে। তা ছাড়া নিজের বা অন্যের ধারণা অনুযায়ী গ্লিসারিন মাখাও ঠিক হবে না। কারণ গ্লিসারিন ব্যবহারের ফলে ত্বকের ময়েশ্চার ধরে রাখতে সাহায্য করলেও পরে ত্বক অনেকটাই শুষ্ক করে তোলে। তাতে ফল হয় উল্টো।
গোসলের পানি: গোসলের সময় পানি হালকা গরম করা উচিত। কারণ ঠাণ্ডা পানি ত্বকের জন্য বেশি শুষ্ক হতে পারে।
শ্যাম্পু: সপ্তাহে অন্তত দু’দিন শ্যাম্পু করা ভাল। তবে খুব ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে একদিনই যথেষ্ট।
জামাকাপড়: সুতির জামাকাপড় পড়া উচিত। পশমের জামাকাপড় পরার আগে ফুল স্লিভ সুতির পোশাক পরে তার ওপরে পোশাক পরা প্রয়োজন। উলের পোশাক সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে আসলে ত্বকের এলার্জি সৃষ্টি হতে পারে।
নিয়মিত খাবারদাবার: প্রতিদিন খাবারের তালিকায় যেন ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-সি বেশি থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। নিয়মিত সবুজ শাকসবজি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। বিশেষ করে, বড়দের চেয়ে ছোটদের সোরিয়াসিস রোগে রেসপন্স ভাল হয়। কিন্তু বাচ্চাদের সারা শরীরে সোরিয়াসিস থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ত্বকের এলার্জি রোগের চিকিৎসা
সোরিয়াসিস প্রধানত শুষ্ক ত্বকের জন্য খুব বেশি সমস্যা। যতটা সম্ভব ত্বকে তেল, ময়েশ্চারইজার লাগিয়ে ভিজে ভাব সুরক্ষিত রাখতে পারলে খুব ভাল উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ইমোলিয়েন্ট, ডোভোনেক্স এবং নানারকম স্টেরয়েড লাগানো যেতে পারে। তবে সে ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
এ ছাড়া খাওয়ার ওষুধ হিসেবে সোরালেন, মেথোট্রিক্সেট, রে়টিনয়েড এবং সাইক্লোস্পোরিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সোরালেন জাতীয় ওষুধ শিশুর বয়স আট বছর হওযার আগে দেওয়া যায় না। তার কারণ আট বছরের আগে এই ওষুধ ব্যবহারে বাচ্চাদের চোখের ক্ষতি হতে পারে। এটা অবশ্যই
মনে রাখতে হবে যে, যে-কোনও খাওয়ার বা ত্বকে লাগানোর ওষুধ ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার পরে তাঁর নির্দেশ মতো ব্যবহার করা উচিত।
সোরিয়াসিসের কিছু শর্ত রয়েছে: সোরিয়াসিস রোগ হলে কিছু শর্ত মেনে চললে উপকার পাওয়া যায়। যেমন,
প্রতিদিন গোসলের আগে অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল মাখা উচিত। গোসলের পরে প্রয়োজনীয় ইমোলিয়েন্ট বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া গোসলের আগে মাখলে তেমন উপকার পাওয়া যাবে না।
একটু বড় শিশুদের জন্য নিয়মিতভাবে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও মৌসুমী ফল খাওয়ানো উচিত। তাছাড়া যতটা সম্ভব সুতির জামাকাপড় পরা ভাল। সোরিয়াসিস হলে শুকনো চামড়াগুলো উঠে যায়। তাতে প্রোটিনের ঘাটতি হয়, তাই প্রতিদিন প্রোটিন জাতীয় খাদ্য বেশি করে খাওয়ানো একান্ত প্রয়োজন।
সূত্র:- Right News BD